খুলনা মহানগর থেকে জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম, প্রতিটি জায়গায় মিলছে লাশ। অভ্যুত্থানের পর থেকে শুরু হওয়া লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। গত এক মাসে দুর্বৃত্তের হামলায় খুন হয়েছে ৮ জন। রহস্যজনক মৃত্যুর পর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ৪ জনের। আর প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়েছে ১২ জন।
এর মধ্যে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছে দু’জনকে। সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে ৫ জনকে এবং পিটিয়ে ৫ জনকে গুরুতর জখম করেছে।
এসব হত্যা ও হামলা ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত ১১ সেপ্টেম্বর নগরীর ৮ থানার ওসি পদে রদবদল করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, “অভ্যুত্থানের আগে মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ হতো শেখ বাড়ি থেকে। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে মাদক সিন্ডিকেট ভেঙে যায়। সন্ত্রাসীরা নানা দল, উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মাদক বিক্রির নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রতিনিয়ত সংঘাতে জড়াচ্ছে তারা। পাশাপাশি কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী ও কিশোর গ্যাং সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে দিন দিন অশান্ত হয়ে উঠেছে খুলনার জনপদ।”
হত্যা-মারামারির জন্য মাদককে দায়ী করলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না বলে অভিযোগ করছেন নাগরিক নেতারা। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান পরিচালনার দাবি তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে রূপসা উপজেলার রাজাপুর গ্রামে পারিবারিক কলহে স্বামীর দায়ের কোপে গৃহবধূ পারভীন বেগম খুন হয়। একই দিন রাত ১১টার দিকে একই উপজেলার জয়পুর একটেল টাওয়ারের পেছনে মাস্টার বাড়ির গেটের সন্নিকটে বি-কম্পানির সক্রিয় সদস্য ইমরান হোসেন মানিককে (৩৪) গুলি করে হত্য করা হয়।
৮ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের গুনারী ২নং ওয়ার্ডে পূর্ব শত্রুতার জেরে রেখা রানী মন্ডল (৪২) নামে এক নারীকে হত্যা করা হয়।
২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে ফুলতলার জামিরা বাজারে চাঁদাবাজির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বাড়ি থেকে ধরে এনে গণপিটুনি দিয়ে আলমগীর হোসেন রানা (৩৮) নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়।
২৩ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর হরিণটানা থানার কেডিএ ময়ূরী আবাসিক এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনের বাথরুম থেকে দিনমজুর নারী মনোয়ারা বেগম সুপ্তির গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে নগরীর লবণচরা থানার নিকটবর্তী কেসিসির মাটির ডিবির সামনে থেকে অজ্ঞাত বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
২৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে রূপসা থানার জাবুসা চৌরাস্তা মোড় সন্নিকটে আইডিয়াল কোম্পানির পুকুর থেকে হাত-পা বাধা অবস্থায় অজ্ঞাত ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে রূপসা থানা পুলিশ।
৩০ সেপ্টেম্বর দিনগত রাত আড়াইটার দিকে দৌলতপুর থানাধীন মহেশ্বরপাশার পশ্চিমপাড়ায় নিজ ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় তানভীর হাসান শুভকে (২৮) গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এছাড়া প্রতিপক্ষের হামলায় গত এক মাসে ১১জন আহত হয়। এর মধ্যে ৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টার দিকে ডুমুরিয়ার খর্ণিয়া-বসুন্দিয়া সড়কে প্রনব কুমার ঘোষের বাড়ির গরু চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে আড়ংঘাটা গাইকুড়ের মনির শেখ (৪৩), খালিশপুরের টিপু মুন্সি (৪৮) ও মিরেরডাঙ্গার রবিউল ইসলাম (৩৮) গুরুতর আহত হয়।
১২ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে খালিশপুর বাজার রোডে ১১ নং ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক মাসুদ হোসেনকে (৪৫) কুপিয়ে জখম করে।
১৭ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে রূপসা উপজেলার আইচগাতী এলাকায় খুলনা জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব আবু হোসেন বাবুর বাড়িতে বোমা হামলা ও গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে।
১৮ সেপ্টেম্বর দিনগত গভীর রাতে নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তদের অস্ত্রাঘাতে মোঃ হাবিব শেখ নামে এক যুবক জখম হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা সদর থানাধীন বাগমারা চেয়ারম্যান বাড়ির মোড়ে ছোট ভাইয়ের দায়ের আঘাতে বড় ভাই শাহাদাত হোসেন জখম হয়।
২২ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে হরিণটানা থানাধীন বাচ্চু মিয়ার গোরস্তানের সামনে চুরি সন্দেহে পিতা-পুত্রকে মারপিট করা হয়।
২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল পৌনে ৫টার দিকে নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন গাবতলা এলাকায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে মোঃ রিয়াজ (২৩) নামে এক যুবক আহত হয়।
২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে নগরীর রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে অনিক নামে এক যুবককে গুলি করে দুর্বৃত্তরা।
২৮ সেপ্টেম্বর রবিবার গভীর রাতে নগরীর হাজী মালেক কলেজ এলাকায় এক ছিনতাইকারীর হাতে অপর ছিনতাইকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী আশিক গ্রুপের সদস্য মোঃ মুন্না ওরফে কাটিং মুন্না গুলিবিদ্ধ হয়।
৩০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে রূপসা উপজেলার ইস্টার্ন জুট মিলে দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রাঘাতে ফয়সাল (২৬) নামে এক যুবক আহত হয়।
অপরদিকে এ সময়ের মধ্যে ৪ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরমধ্যে ১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে বটিয়াঘাটা কাজীবাছা নদী থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
১৪ সেপ্টেম্বর রাত সোয়া ৮টার দিকে খুলনার সদর থানার সামনে স্টার হোটেলের একটি কক্ষ থেকে তৌহিদুর রহমান তুহিন (৩৫) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
২৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টার খুলনার শিপইয়ার্ড ১নং পল্টুনের সাথে ভেসে থাকা অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে নৌপুলিশ।
২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় দাকোপের চুনকুড়ি খেয়াঘাট থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক নারীর (৪০) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
কেএমপি পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) মোঃ রাশিদুল ইসলাম খান বলেন, খুলনাঞ্চলে সব থেকে বড় সমস্যা মাদক। খুলনায় যতগুলি হত্যা বা হামলার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগ এর নেপথ্যের কারণ মাদক। তবে এসব নিয়ন্ত্রনসহ আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে আমরা কাজ করে চলেছি।
খুলনা গেজেট/এনএম